বিরুদ্ধ স্রোতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন

বিরুদ্ধ স্রোতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন

By: Muhammad Farid Hasan

বিরুদ্ধ স্রোতের নাসিরউদ্দীন

কালের গর্ভ অতল, কালের কুম্ভ অনন্ত। সে গর্ভ হতে ভবিষ্যত জন্ম দেয় অনাগতকে আর অতীত সে কুম্ভে টেনে নিয়ে যায় একদার বর্তমানকে। অতীত হয়ে যাওয়া কোন এক বর্তমানের হীরণ ব্যক্তি বা ঘটনাগুলো বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায় এক সময়। কালের সেই খনিকে উৎখনন করে অনুসন্ধিৎসু মানুষ পায় প্রকৃত হীরের সন্ধান। এ রকম উৎখনিত এক হীরকের নাম মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। আরও স্পষ্ট করে বললে ‘সওগাত’-এর সম্পাদক নাসিরউদ্দীন। কালের গর্ভে প্রতœতাত্ত্বিক খনন করে যারা বিস্মৃতপ্রায় নাসিরউদ্দীনকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন তারা দুই তরুণ সম্পাদক কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। তাদের যৌথ প্রয়াসে লব্ধ এই প্রতœ সম্পদের বিবরণী দুই মলাটে ধারণ করে গ্রন্থরূপ পেয়েছে ‘বিরুদ্ধ ¯্রােতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।’ পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে উপলক্ষ করে জানুয়ারি ২০২০-এ প্রকাশিত গবেষণাধর্মী এই গ্রন্থটি শিল্পী গৌতম ঘোষের নান্দনিক ও তাৎপর্যবহ প্রচ্ছদে আটটি বিশেষ রচনা, আটটি মূল্যায়ন গদ্য, আটটি নজরুল ও নাসিরউদ্দীন সম্পর্ক বিষয়ক রচনা, পাঁচটা স্মৃতিচারণমূলক লেখা, নাসিরউদ্দীনের আত্মকথা, নাসিরউদ্দীনের বাড়িতে পড়াশোনা করে বড় হওয়া ভ্রাতুষ্পুত্রের সাক্ষাৎকার, নাসিরউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি বিষয়ক একটি মুক্তগদ্য এবং মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের জীবনপরিক্রমা নিয়ে সমৃদ্ধ। মোট দুইশ’ চল্লিশ পৃষ্ঠার আয়তনে দৃশ্যমান ‘বিরুদ্ধ ¯্রােতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন’ বইটি গুণে-মানে-সংখ্যায় সুপুষ্ট কলেবর ধারণ করেছে। কালের বিকীর্ণ প্রজ্ঞায় সওগাত যুগের প্রবক্তা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ওপর গবেষণাধর্মী এ সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে প্রায় তিরিশোর্ধ লেখকের মূল্যবান রচনা। যাতে বিশেষ রচনা ও মূল্যায়ন গদ্যের সন্নিবেশ উল্লেখযোগ্য। আটটি বিশেষ রচনার লেখকগণ হলেন : মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন নিজে, সুফিয়া কামাল, ওবায়েদ-উল হক, নূরজাহান বেগম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যারা মূল্যায়নধর্মী গদ্যে সমৃদ্ধ করেছেন ‘বিরুদ্ধ ¯্রােতের মোহম্মদ নাসিরউদ্দীন’কে তারা হলেন : আসমা আব্বাসী, নাসিম-এ-আলম, পূরবী বসু, ফিরোজ আহমেদ, পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, মুহম্মদ সালাহউদ্দীন ও আবদুর রাজ্জাক। নজরুল ও নাসিরউদ্দীনের সম্পর্ক বিষয়ে লিখেছেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, জাতীয় অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম এবং আতাউর রহমান। এ ছাড়াও স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর মেয়ের জামাতা রোকনুজ্জানান খান, সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ফোকলোরবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ও নাসিরউদ্দীনের নাতনী ফ্লোরা নাসরীন খান। নাসিরউদ্দীনের ভ্রাতুষ্পুত্রের সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন কাদের পলাশ। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের জন্ম ১৮৮৮ সালের ২০ নবেম্বর, চাঁদপুরের পাইকারদি গ্রামে। নদী ভাঙ্গনের কারণে পরবর্তীতে নানাবাড়ি চালিতাতলী গ্রামে তারা বসত গেড়েছেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এসএ সুলতান টিটুর ভাষ্য হতে জানা যায়, নদীর করাল গ্রাসের কারণেই তাদের সবসময় একটি বিকল্প বাড়ি থাকত। নাসিরউদ্দীনের পিতা আবদুর রহমান ইংরেজী শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। মাতা আমেনা বেগম ছিলেন সরলসিধে। শাহীন আখতারের অনুলিখনে নাসিরউদ্দীনের স্মৃতিচারণ ‘আমার মা আমেনা বিবি’ হতে জানা যায় তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ তথা নাসিরউদ্দীনের স্ত্রীকে মেয়ের মতোই ভালবাসতেন। কেননা, তাঁর আট ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মেয়েটি অল্প বয়সেই মারা যায় এবং পরে আট ছেলে হতে চার ছেলে জীবিত থাকে। কন্যার শূন্যতা বড় পুত্রবধূকে দিয়ে তিনি পূরণ করেছিলেন। বালকবেলায় পিতৃহারা নাসিরউদ্দীন একসময় এত প্রতিষ্ঠিত হবেন তা কেউ কল্পনাও করেনি। বিশেষ রচনায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ‘সওগাত’-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবতারণা করেছেন। যেখান হতে আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথের ‘সওগাত’ নামটি পছন্দ হওয়ার কথা। যদিও তাঁর লেখার স্বত্ব তিনি বিশ^ভারতীকে দান করেছিলেন, তবু নাসিরউদ্দীনের প্রয়াস এবং কাতর মুখাবয়ব দেখে তিনি লেখার বিনিময়ে সম্মানী না নিয়ে ‘পথের সাথী’ কবিতা এবং ‘সওগাত’ নামে কথিকা পাঠিয়েছিলেন। সুফিয়া কামাল তাঁর লেখায় নাসিরউদ্দীনকে সত্যিকারের নির্মাণশিল্পী বলে উল্লেখ করেছেন। যা বাস্তব অর্থেই তাঁর জন্যে প্রণিধানযোগ্য। মেয়ে নূরজাহান বেগমের চোখে তাঁর বাবা ছিলেন চিন্তাশীল ও কর্মময় মানুষ। আব্দুল কাইয়ুমের লেখায় নজরুল ও নাসিরউদ্দীনের সম্পর্ক যেন মধ্যযুগের আলাওল আর কোরেশী মাগনের সঙ্গে সমতুল্য বলে ফুটে উঠেছে। প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তাঁকে কালের মহীরুহ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন কালজয়ী অবদানের জন্য। এক শ’ ছয় বছর জীবন পাওয়া এই কর্মবীর আসমা আব্বাসীর কাছে শতাব্দীর মহীরুহ। পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার মূল্যায়ন গদ্যে নাসিরউদ্দীন তাঁর জন্মভূমির নদীর মতোই প্রবহমান হয়ে চিত্রিত হয়েছেন। মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের গদ্যে বিরুদ্ধ ¯্রােতে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সংগ্রামী জীবনটাই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সওগাত ও নাসিরউদ্দীনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল নারী শিক্ষার প্রসার। এই দিকটি চমৎকারভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে আবদুর রাজ্জাক ও মুহম্মদ সালাহউদ্দীনের আলোচনায়। নজরুলকে নিয়ে নাসিরউদ্দীনের সাক্ষাতকার এবং নজরুল-নাসিরউদ্দীন সম্পর্কের বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের লেখাটি এই গ্রন্থের অনন্য সম্পদ। নজরুল বিশেষজ্ঞ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, করাচী হতে নজরুলে পাঠানো মোট দশটি লেখা হতে চারটি লেখা ছাপানো হয়েছে সওগাতে। পাশাপাশি নজরুলের প্রথম লেখা ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ এবং শেষ লেখা ‘কবির মুক্তি’ সওগাতেই ছাপা হয়েছে। ‘বিরুদ্ধ ¯্রােতের মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন’ গ্রন্থে দুটি বিরল দলিল পত্রস্থ হয়েছে। একটি হলো নজরুলের দুর্দশায় সংবেদনশীল হয়ে কবি সুফিয়া কামাল কর্তৃক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে লেখা মর্মস্পর্শী পত্র। অন্যটি ১৯৮৬ সালে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠাকালিন প্রকাশিত স্মরণিকায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের লেখা শুভেচ্ছাপত্র। এ দুটি পত্র নাসিরউদ্দীনের স্মৃতি উৎখননে পাওয়া অমূল্য রতœ সম্ভার। নাসিরউদ্দীনের দৌহিত্রী ফ্লোরা নাসরিন খানের স্মৃতিচারণে নানা ভাইয়ের প্রশস্ত বুকে নানা ভাইয়ের কণ্ঠে গাওয়া গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার মনকাড়া স্মৃতি চয়িত হয়েছে। আরও একটি মজার তথ্য আমরা তাঁর নাতনির স্মৃতিচারণ থেকে পাই এবং তা হলো ফ্লোরাকে সম্বোধন করা কয়েক পঙ্ক্তি ছন্দোবদ্ধ ছড়া আর তিনি তাতে সুর করে বলেছেন : ‘নাতিনী ফ্লো নাতিনী/চাঁদ নহে চাঁদিনী/তোর তরে তারার হার/আজও আমি গাঁথিনী।’ গবেষণার উৎকর্ষ এ গ্রন্থে যেমন লক্ষ্যণীয় তেমনি গ্রন্থের কয়েকটি দুর্বল দিকও রয়েছে। একই গ্রন্থে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর দুটি লেখা স্থান পেয়েছে। একটি ‘নজরুল ও নাসিরউদ্দীন’ এবং অন্যটি ‘নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা : মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ভূমিকা।’ নজরুল ও নাসিরউদ্দীনের সম্পর্ক বিষয়ে লেখাগুলো প্রায়ই একই কথার পুনারবৃত্তি। এখানে নাসিরউদ্দীন, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং রফিকুল ইসলামের লেখা থাকলেই তা যথেষ্ট সম্পন্নতা পেতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাক্য সম্পূর্ণ হয়নি বলেও মনে হয়েছে। বেগম পত্রিকা নিয়ে আলোচনাটা প্রত্যাশা মোতাবেক আসেনি বলে বেগম নিয়ে নাসিরউদ্দীনের ভাবনা-চিন্তাগুলো অজানা থেকে গেলো। চারশ পঞ্চাশ টাকা ধার্যমূল্যে প্রকাশিত এ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে একসময় ‘সওগাত’-এর ধ্বজাধারী সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও চাঁদপুরের সাচনমেঘের সন্তান শান্তনু কায়সারকে। সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন তাঁর জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “আমার জীবন বলতে ‘সওগাত’-এর জীবনকেই বুঝি। কারণ আমার ব্যক্তিগত জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। আমার যা-কিছু তার সবই ‘সওগাত’ এর কারণে।” কাজেই সওগাত মানে যেমন নাসিরউদ্দীন তেমনি নাসিরউদ্দীন মানেই সওগাত। সমাজের ও সময়ের বিরুদ্ধ স্রোত ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পয়গাম বা বার্তা কেবল নাসিরউদ্দীন একা পাননি, ‘সওগাত’ নিজেও পেয়েছে। তাই তো ‘সওগাত’ ও নাসিরউদ্দীন উভয়েই শতবর্ষ পেরিয়েও আজ সমধিক জীবন্ত ও উজ্জীবনী। বাঙালীর শিক্ষক আনিসুজ্জামানের আশীর্বাণী ও তাঁর বিশেষ পরিচর্যা পাওয়া গ্রন্থখানি বিদিত হোক বিশ্বময়- এই শুভাকাক্সক্ষা জড়িয়ে থাকুক বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে বিজয়ী ‘মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন’ ও ‘সওগাত’-এর সঙ্গে।

No reviews yet.