By: Muhammad Farid Hasan
যাপনে-উদযাপনে ইলিশ ॥ ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ
‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাটা, বোয়াল মাছের দাঁড়ি।’ ছোটবেলায় এই প্রবাদ বাক্য শুনেনি এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঠিক একইভাবে বাজারে বড় ইলিশ মাছটি দেখলে তার দিকে একবার হলেও চোখ বুলাবে না তেমন লোক ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাছে ভাতে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন মাছের প্রভাব থাকলেও ইলিশের নাম আসলেই সেটা একটু ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। জেলের নৌকা, মাছের বাজার, রান্নাঘর হয়ে খাবারের প্লেটে ওঠা পর্যন্ত ইলিশ মাছের আদর- সমাদর একটু বেশিই বটে! আবার চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ হিসেবে জামাই ষষ্ঠীর জোড়া ইলিশ, মেঘলা দিনের ভাজা ইলিশ, মায়ের হাতের সরিষা ইলিশ কিংবা সবশেষ সংযোজন বৈশাখী উৎসবে পান্তা ইলিশ সবগুলোই আমাদের জন্য বিশেষ উপলক্ষ বয়ে আনে। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট মাছ নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে এত মাতামাতি হয়নি যতটা ইলিশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হয়েছে। প্রাচীন সাহিত্য থেকে আধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত চোখ বুলালে এমন অনেক নিদর্শন পাওয়া যাবে। ইলিশ চিরায়ত বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ইলিশের নাম আসলেই যেসব অঞ্চলের নাম আসে তার মধ্যে চাঁদপুর সর্বপ্রথম। নদী ও জলে ভরপুর চাঁদপুরের বুকে ইলিশের অভয়াশ্রম, জন্মস্থান, বেড়ে ওঠা ও বিপণন প্রায় সবকিছুই সম্পন্ন হয়। ইলিশ নিয়ে চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ যেমন গর্বিত ও উচ্ছ্বসিত, ঠিক একইভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও সমানভাবে তৎপর ইলিশ কে তুলে ধরার জন্য। ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসন যখন অদম্য উদ্যমে চাঁদপুর জেলাকে ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ শুরু করেন তখনই সেই উদ্দীপনার বারুদে আগুন হয়ে এগিয়ে আসে চাঁদপুর লিটলম্যাগ ফোরাম ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। প্রশাসন ও লিটলম্যাগ কর্মীদের যৌথ প্রয়াসে ‘জলপুষ্প’ নামক একটি মুখপত্র প্রকাশিত হয় যা ব্র্যান্ডিং কর্মযজ্ঞের স্মারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর সম্পাদনায় ছিলেন সৌম্য সালেক, কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। পরবর্তীতে আরও পরিমার্জিত ও সংশোধিত হয়ে ‘যাপনে উদযাপনে ইলিশ’ গ্রন্থটির জন্ম হয়। এক মলাটে ইলিশ সংক্রান্ত গবেষণা, কবিত, গল্প, রম্য ও সাক্ষাতকার সবমিলিয়ে ব্যতিক্রমী এক সংকলনের নাম ‘যাপনে উদযাপনে ইলিশ’। এ বইটি একবার হাতে নিলে একবারে পুরোটা পড়ে শেষ করার ইচ্ছা জাগবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২৩২ পৃষ্ঠার এ সংকলনে বাংলা সাহিত্যের রথি মহারথিদের ইলিশ ভাবনার পাশাপাশি সমকালীন লেখকদের সাহিত্য ও চমৎকার প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, শাইখ সিরাজ প্রমুখের ইলিশ বিষয়ক বিশেষ গদ্য আমাদের ইলিশ ভাবনায় নতুন চিন্তার রসদ জোগায়। অন্যদিকে কবিতা ও ছড়া অংশে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ইলিশের ছড়া ও চমকপ্রদ বটে! আমাদের চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে নিয়ে ইলিশ কৌতুকটিও চমৎকৃত করে যে কোন পাঠক কে। সাম্প্রতিক সময়ের দুই জনপ্রিয় লেখক হরিশংকর জলদাস ও আনিসুল হকের লেখাও স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। বাদ যায়নি আধুনিক বাংলা উপন্যাসের প্রবাদ পুরুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিরায়ত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। সামগ্রিক সাহিত্যে ইলিশ ভাবনার ধ্রুপদী ও সমকালীন সাহিত্যের সম্মিলন ঘটানোর এক অনন্য প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় ‘যাপনে উদযাপনে ইলিশ’ নামক গ্রন্থে। ইলিশ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের গর্ব নয়, ইলিশ পুরো বাঙালী জাতির গর্বের বিষয়। ইলিশ বিষয়ক বৈচিত্র্যময় সাহিত্যই তা প্রমাণ করে। শুধু তাই না, ইলিশ নিয়ে আমাদের ভাবনাকে আরও বিচিত্র ও বহুমুখী করে তোলে এই সংকলন পাঠ। সম্পাদক হিসেবে সৌম্য সালেক, কাদের পলাশ ও মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের নিপুণ মুন্সিয়ানা ও পরিশ্রমের প্রতিফলন ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের প্রচার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে ইলিশ বিষয়ক আলোচনা, গবেষণা ও চর্চার জন্য অফুরন্ত চিন্তার রসদ হিসেবে এই সংকলন গ্রন্থ এক অনন্য মাইলফলক হবে বলে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যায়।
No reviews yet.