Story Image

আত্মহত্যার আগে। মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

অবশেষে নিজেকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। এ সিদ্ধান্তে এত সরলভাবে পৌঁছলো যে, তার মনে দ্বিধার বিন্দুমাত্র রেশ ছিলো না। তাই অবলীলায় মনে হয়েছে, পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আর কোনো কাজ নেই, প্রেম নেই, বেদনা, দ্রোহ কিছু নেই। যেখানে ভালোবাসার মানুষ থাকে না, যে যাপনে হাসিতে লুটিয়ে পড়া যায় না অথবা যে সারাদিন বিমর্ষ বিমর্ষ মুখ নিয়ে ঘোরাফেরা করেÑতাকে বাঁচতে দেয়ার কোনো মানে হয় না। যার মনের মৃত্যু হয়ে গেছে বহু আগেইÑতারজন্যে অনুতাপ কেন? বরং দেহজ মৃত্যুর পাঠ শেষে জানাজা দিয়ে কবরের পথে যাত্রাই একমাত্র তার জীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। নিজের ব্যর্থতার এমন অজস্র বিষয় তার মাথার ভেতর শিকারী চিলের মতো চক্কর দেয়। এভাবে অনেকদিন কেটে যায়, হয়তো অনেক দিন নয়। সে জানে সুখহীন সপ্তাহকে মাস এবং মাসকে অনেক অনেক বছর বলে মনে হয়। ছাদের রেলিংয়ের ওপর ওঠে তাই সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে ওঠার সাহস সে জীবনে আর দ্বিতীয়বার পায়নি, আর পাবেও না হয়তো। দশতলা থেকে নিচে তাকাতেই মনের ভেতর অদ্ভুত আনন্দ ঘোরপাক খায়। ছোট একটা লাফ দিলে মুহূর্তেই মুছে যাবে জীবনের সকল দুঃখ, দাহ আর যন্ত্রণার নামতা। সে মৃদু হাওয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে। তার চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে ওঠা অসংখ্য সাদা সাদা আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।

একরাশ অন্ধকারের ভেতর ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি খেলা করে। কতইবা বয়স হয়েছে তারÑআটাশ বা ঊনত্রিশ! এ দীর্ঘ সময়ের দিকে তাকিয়ে আজ কত কী মনে পড়ে। অথচ এই ভয়াল মুহূর্তে ভালো কোনো স্মৃতি মনে পড়ছে না। অবশ্য মনে পড়ার কোনো কারণও নেই। অল্পজীবনে এত বেশি বিতৃষ্ণা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এমনভাবে গ্রাস করে রেখেছেÑতাই সুখের স্মৃতিগুলো ওপর জং ধরে গেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে সে ঝুলে আছে বলেই হয়তো কিছু কিছু মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা-মা, নীহারিকা, সুনন্দা, নদী, বাবুল, মহুয়া...। ভাবতে অবাক লাগে, সে ছিলো পরিবারের সবচেয়ে চঞ্চল বালক। ক্লাসে তার দুষ্টুমির কথা সর্বজনবিদিত হয়ে আছে। সে যতটুকু হাসতো, তারচেয়ে বেশি হাসাতো অন্যদের। বন্ধুদের কারো মন খারাপ হলে তাকে কল দিয়ে বলতো, ‘রায়হান তোর হাতে সময় আছে? মনটা খুব খারাপরে। তোর সাথে একটু কথা বলি।’ সেও বন্ধুদের না করতো না কখনো। প্রচুর সময় দিতো। মন দিয়ে ওদের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, অভিমানের কথা শুনতো। এমনই একদিন মহুয়ার সাথে তার পরিচয় মন ভালো করার সূত্র ধরে। মহুয়ার মন সে ভালো করতে পেরেছিলো ঠিকই, কিন্তু মহুয়াই আবার তার মনকে বিষণ্নতার চাদরে ঢেকে দিয়েছিলো চিরদিনের জন্যে। অবশ্য সে এক অন্য গল্প। অন্য জগৎ। বললে বিশ্বাস হতেও পারে, নাও হতে পারে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের সুতোয় ঝুলিয়ে রেখে মহুয়া তার গল্পটি বলেছিল। কথাগুলো শুনে আঁতকে ওঠেছিল সে। অবিশ্বাসের বিশাল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিল মহুয়ার দিকে। কিন্তু মহুয়ার অসহায় মুখ, কেঁদে লাল হওয়া চোখ দেখে বিশ্বাস হয়েছিলো গল্পটা।


 তার পকেটে রাখা মোবাইলটি বারবার বেজে উঠছে। কল কি ধরবে? চোখ বন্ধ রেখেই পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করে আনে। কে কল করেছে চোখ বন্ধ থাকায় সে বুঝতে পারে না। তবু কল রিসিভ করে মুঠোফোনটা কানে ঠেকায়। তার মনে হয় ওপাশে একটা মেয়ে হু হু করে কাঁদছে। সে বারবার হ্যালো বলার পরও মেয়েটা কথা বলে না, প্রতিউত্তরে তার কান্না আরও বেড়ে যায়। একবার কি চোখ খুলবে সে? দেখবে নম্বরটা কার? ততক্ষণে কলটি কেটে যায়। এক রাশ দ্বিধা নিয়ে সে রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আবার মোবাইলটা বাজতে থাকে। বাজতে থাকুক। সে ভাবে, অন্যের কথা ভেবে কী হবে। সে তো আর পৃথিবীর মুখ দেখবে না। তাই কে কাঁদলো, কে কাঁদলো না, তা ভেবে সময় নষ্ট করা কেন! ছোট একটা লাফ দিলেই সে ওপারে চলে যাবে। জীবন থেকে মৃত্যুর দূরত্ব ছোট একটি লাফ মাত্র। উত্তরের বাতাস এসে গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তার শীত শীত লাগে। মহুয়ার কথা ভাবছিলো সে। মেয়েটির মুখটি কেমন যেন ছিলো। দেখলে খুব মায়া লাগতো। ক্লাসে সবসময় ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছে। তার সাথেও কখনো ওইভাবে কথা বলা হয়নি। তাই মহুয়া যেদিন তাকে কল করেছে পরিচয় পেয়ে সে অবাক না হয়ে পারেনি। মহুয়াও অন্যদের মতো বলেছিল, মনটা খুব খারাপ। কথা বলা যাবে? সেই তো কথা বলা শুরু। মহুয়ার সাথে কথা বলতে তারও ভালো লাগে। মহুয়া কল না দিলে সে নিজেই কল করে খোঁজ-খবর নেয়। এভাবেই বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। তারপর মহুয়া একদিন ডেকে নিয়ে তার মন খারাপের মূল কারণটা বলেছিল। বিভাগের সবুর স্যার তাকে প্রায়ই বিরক্ত করে। একদিন জরুরি কথার নাম করে মহুয়াকে রুমে ডেকেছিলেন। তারপর যা হলো তা বলতে গিয়ে মহুয়া কেঁদে ফেলে। ভার্সিটিকে এখন তার আতঙ্ক মনে হয়। প্রায়ই বলতো, রায়হান আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মহুয়ার সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনতো সে। ততদিনে মহুয়ার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। অথচ অনেকদিন পর সে বুঝেছিলো মহুয়া তাকে ভয়ঙ্কর রকম মিথ্যা বলেছে।

 ‘যদি মন কাঁদে তবে চলে এসো এক বরষায়’...পকেটে রাখা মোবাইলে আবারও রিংটোন বেজে ওঠে। নিজের অজান্তেই ডানহাত গিয়ে কল রিসিভ করে। আগের মতোই চোখ বন্ধ রেখে ওপাশের কথা শোনে। গলা শুনেই সে বুঝতে পারে ইকবাল কথা বলছে। খুব আনন্দিত তার কণ্ঠস্বর। হড়বড় করে কথা বলছে। চারদিকে বাতাস বইছে। ইকবালের কথা শুনে তার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। তবে যতটুকু হয়, ততটুকুই বা কম কি। চাকুরির জন্যে ইকবালের বিয়ে আটকে ছিলো। রূপন্তীর পরিবারের এক কথা। অবশ্য বেকারের হাতে মেয়ে তুলে দিতে কে চাইবে। আজ ইকবালের পছন্দসই চাকুরি হয়েছে। দুপুরেই খবরটা সে জেনেছে। কিন্তু ইকবাল তাকে জানাতে ভুলে গেছে। অথচ সে-ই ইকবালকে রেফার করেছিলো। ইকবালের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। ওরা সুখী হোক এটাই চাইতো সে। ইকবাল জানিয়েছে, মিষ্টি নিয়ে একটু পর বাসায় আসবে। রাতভর গল্প করবে। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও তার হাসি পায়। ইকবাল যখন এসে দেখবে সে দশতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেÑতখন তার মুখটা কেমন হবে? সেই মুখটা দেখার জন্যেই হয়তো সে ইকবালকে আসার জন্যে না করেনি। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে গেলে মোবাইলকে একবার শূন্যে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। সুইসাইড নোটের কথা ভেবে মোবাইল হাতেই রাখে সে। প্রতিদিন কত কত কল আসে। বন্ধুরাই বেশি করে। একেকজনের একেক সমস্যা, সেগুলো সমাধানের ভার পড়ে তার ওপর। কত আন্তরিকতায় সে কত বন্ধুর সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। অথচ তার সমস্যার সমাধান কেউ করেনি, করতে চায়ওনি। প্রথম মৃত্যুর কথা খুব মনে পড়ে। সে আর মহুয়া লাইব্রেরির বাইরে বসে গল্প করছে। ততদিনে তাদের প্রেমের বয়স চার বছরে পা দিয়েছে। কিন্তু বন্ধু সুবন্ত হঠাৎ গল্পের মাঝখানে চলে এলো। হাসিমুখে বললো, দোস্ত, তোর সাথে জরুরি কথা আছে। মহুয়াকে রেখে সে আর সুবন্ত একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলো। সুবন্ত বললো, কিছু মনে করিস্ না দোস্ত, মহুয়ার সম্পর্কে ভালোভাবে জানিস্ তুই? সে অবাক হয়। সে জানে। সুবন্ত তখন একটু বিব্রত হয়ে বললো, ভিডিওটা দেখেছিস্? ভিডিওর কথা শুনতেই তার বুকে খচ করে কিছু একটা বিঁধে যেন। উৎকণ্ঠিত হয়ে সুবন্তের হাত ধরে সে বলে, কীসের ভিডিও! কার? সুবন্ত ম্লান মুখে বলে, ওহ! তাহলে জানিস্ না। অথচ সবাই জানে! সে অদূরে বসা মহুয়ার দিকে তাকায়। মেয়েটাকে কত সুন্দর লাগছে। সুবন্ত বলে, তুই নেটে দেখিস্। মহুয়া ঢাকা লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবি। বলে সুবন্ত আর একমুহূর্তও দাঁড়ায় না, উল্টো দিকে হাঁটতে থাকে। সেদিন কোনোভাবে সে মহুয়ার কাছ থেকে বিদায় নেয়। বাসায় এসে ল্যাপটপ ওপেন করে গুগুলে ঢোকে। সুবন্তের কথামতো সার্চ দেয়। প্রথমে কিছুই পাওয়া যায় না। এদিকে ধুকপুকানিতে তার হৃদপিণ্ড যেন ফেটে যাবে। স্পেলিং চেঞ্জ করার পর অবশেষে কয়েকটি ভিডিও সে পায়। একটিতে ক্লিক করলে সে যা দেখেÑতা জীবনেও দেখবে বলে ভাবেনি। মহুয়ার কামোদীপ্ত মুখটি সে ভিডিওতে স্পষ্ট। কিন্তু পুরুষটির মুখ দেখা যায় না। শারীরিক গঠন দেখে তার মনে হয়, সবুর স্যার! ভিডিওটা তিন লাখের বেশি ভিউয়ার হয়েছে। রিলেটেড আরও কিছু ভিডিও ল্যাপটপের পর্দার একপাশে ঝুলে থাকে। অন্য ভিডিওতে ক্লিক করতে আর সাহস হয় না। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে এসেছিলো, মাথার ভেতর কেবল শূন্যতা অনুভব করে সে। সেদিনই তার প্রথম মৃত্যু হয়েছিলো। পুরানো কথা ভেবে কী লাভ। মৃত্যুই সব বেদনা গ্রাস করতে পারে। দিন যত গেছে, ততই ভেঙে পড়েছে সে। কোনোভাবেই মানতে পারেনি মহুয়া তার সাথে প্রতারণা করতে পারে কিংবা মিথ্যা বলতে পারে। মহুয়াকে সে ভিডিওর কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। কিছু না বলেই মহুয়া চলে গিয়েছিলো এবং আর কখনো আসেনি, কল করেনি, কল ধরেওনি। মহুয়াকে মিথ্যাবাদী আর বিকৃত মানসিকতাধারী মনে হয়েছে বারবার। সুবন্ত শান্ত্বনা দিয়েছিলো। সত্যিই তো, মহুয়া গেছে অথচ বাকি জীবন সামনে পড়ে আছে। অন্য কাউকে সে ভালোবাসতে পারে। নিজেকে কতবার বুঝিয়েছে এসব, অথচ তার মন বাঁধ মানেনি। দিনে দিনে তার মনোবল কমে গেছে। এখন তার কাছে জীবন ও মৃত্যুর বিশেষ কোনো তফাৎ নেই। চোখ বন্ধ অবস্থায় তার চোখে এখনও মহুয়ার ছবি ভাসে। তার ছবি ঘৃণা ও মৃত্যুকে উস্কে দেয় যেন।

রেলিংয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সে। পা ঝিমঝিম করছে। মৃত্যু মাথার ওপর ঝিমঝিম করছে। পুরো ছাদ ফাঁকা। অবশ্য রাতে তেমন কেউ ছাদে আসে না। সে মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। বিশেষত বাবা মায়ের কাছে। তারা তাকে নিয়ে কত কী স্বপ্ন দেখেছেন। সে তাদের একমাত্র ছেলে। ছোটবোন ঝর্ণাকে নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হবে। তার আত্মহত্যায় সুবন্ত হয়তো বেশি কষ্ট পাবে। নীহারিকা, সুনন্দা, নদী, বাবুলও তাকে দেখতে আসবে। তারা ভাবতেই পারবে না, যে তাদের বাঁচতে শিখিয়েছে, সে-ই আত্মহত্যা করেছে! আর ইকবাল? মিষ্টি নিয়ে এসে দেখবে তার বন্ধুটি উড়ে গেছে। সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। স্রষ্টার কাছে শেষবারের মতো প্রার্থনা করে রায়হান। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। নতুবা ইকবাল এসে পড়বে। মোবাইলে একটা সুইসাইড নোট লিখে রাখা হয়েছে। তার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়Ñএই জাতীয় কথা সেখানে লেখা। মোবাইলটা রেলিংয়ে রাখতে যাবে এমন সময় রিংটোন আবার বেজে ওঠে। রাত অনেক হয়েছে। দ্বিধায় দুলতে দুলতে কল রিসিভ করতেই সে পুরানো কান্না শুনতে পায়। একটা মেয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কান্নার আলাদা কোনো স্বর থাকে না। নতুবা সে বুঝে নিতো কে কাঁদছে। সে দ্বিতীয়বার হ্যালো বলতেই কাঁদো কাঁদো গলায় মেয়েটা বলে, ভাইয়া তুই কই? মা স্টোক করেছেন। তোকে এতবার কল করছি...। মেয়েটা হড়বড়িয়ে বলতে থাকে। কান্না আর কথা এক হয়ে তার কানের মধ্যে মিশে যায়। তবু ছোটবোন ঝর্ণার কণ্ঠ তার চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। মা স্টোক করেছেন! বিদ্যুৎ চমকানোর মতো একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সে চোখ খোলে। তার সামনে মিটমিট করে জ্বলতে থাকে অসংখ্য আলো।