Profile Image

Muhammad Farid Hasan

Writer, Researcher & Journalist
Menu
Story Image

মাছরাঙা মানুষ

মাছরাঙা মানুষ
 মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

সোনালী আলোর নিচে প্রতিদিন মাছরাঙা হয়ে বসে থাকি পথিকরা কে কখন গৃহে ফিরছে, কে কথা বলছে কার সাথে কিংবা কার মুখ মন খারাপের বাড়ি হয়ে বসে আছে তার খোঁজ আমি রাখি নাকেউ যদি ভুলক্রমে আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে, আমি কে এবং আমি কী করিতখন বরং চোখ ঈষৎ ওপরে তুলে দেখি মানুষটি দেখতে কেমন, তার চোখ কী জানতে চায় কারো প্রশ্নের জবাবে আমি উত্তর দিই না সচারাচর উল্টো আগন্তুকের কাছে জানতে চাই, তিনি কি কখনো দেখেছেন একটা মানুষ খুন হয় কীভাবে? অথবা, কোনো হেমন্ত দিনে কাউকে রোদে গোছল করতে দেখেছেন? এমন প্রশ্ন শুনে মানুষ স্বভাবতই ভিমড়ি খায়, তাদের চোখের পাতা বারবার কেঁপে ওঠে আগন্তুক মনে করেন তিনি নির্ঘাত পাগলের পাল্লায় পড়েছেন অথবা লোকটি ঘণ্টাখানিকের মধ্যে পাগল হতে যাচ্ছে এর প্রতিক্রিয়া এমন হয়, লোকটি চারপাশে একবার তাকায় এবং আর দেরি না করে হনহন করে সোজা হাঁটতে থাকে গন্তব্যের দিকে তারপর একটু দূরে পৌঁছে গেলে আগন্তুক আবার পেছনে ফিরে আমাকে অদ্ভুত চোখে পর্যবেক্ষণ করে আমি তার প্রতিক্রিয়ায় বহুদিনের জং-ধরা ঠোঁটে হাসতে থাকিআমি কে জাতীয় প্রশ্নগুলো যে প্রতিদিন মানুষ আমার কাছে উৎসুক হয়ে জানতে চায় এমনটি নয় সপ্তাহে দু-একদিন এমন ঘটনা ঘটে আমি দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, আগন্তুক পেলে আমি কেমন বোবা হয়ে যাই, অদ্ভুত উদ্ভট আচরণ করি যদিও প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আমার মনের ভেতর অসংখ্য কথা হলদে পাখি হয়ে ওড়ে বেড়ায় কোনো কোনো মরচে-পড়া বিকেলে আমি বিগত দিনের গর্তগুলো থেকে স্মৃতিবহ ঘটনাসম্ভার টেনে টেনে বের করি যদিও এপথ দিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের মনে প্রশ্ন উথিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়প্রায় বিকেলে মানুষটিকে দেখি এখানে, এই বৃক্ষের নিচে চুপচাপ বসে আছেন, তার চোখগুলো পাথরের মতো স্থির কিন্তু লালএভাবে সূর্য ডোবার আগে কেন বসে থাকেন তিনি? আমি জানি বেশিরভাগ পথচারীর মনেই এমন প্রশ্ন চায়ের ধোঁয়ার মতো ঘুরপাক খায় কিন্তু তারা প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেন আর যারা আমাকে প্রশ্ন করেন, তখন আমার পাল্টা প্রশ্নে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খান এবং দেরিতে বাড়ি ফেরা পথিকের মতো দ্রুতপদে চলে যান

আমি কেন এখানে বসে থাকি এর হয়তো অনেক কারণ আছে আমার কাছে, যে ব্যাখ্যা অন্য কেউ সহজে বুঝতে পারবে না কদাচিৎ কেউ যদি বুঝতে পারে তাহলে তিনি হয়তো করুণার দৃষ্টিতে আমাকে পরখ করবেন এবং শ্রাবণের বৃষ্টির ফোঁটার গতি নিয়ে তার আফসোস আমার কানে বর্ষিত হবে আবার এই অপেক্ষার অন্তর্লীন যে বিভৎসতা সেটা শুনে অনেকে চমকে যেতে পারেন অনায়াসে আমি নিঃসঙ্গ মানুষ, কেউ নেই, না ছেলে না মেয়ে, বয়সও শেষ প্রান্তে; তাই কারো করুণা, চমক কিংবা আফসোস শুনতে আমি আগ্রহী নই বরং মানুষকে দেখা এবং কাউকে বিহ্বল দেখতে পেলে ভালো লাগে, নিজের অজান্তেই নিজে নিজে হেসে উঠি মানুষ হয়তো পাগল মনে করে, অথবা ভিন্ন কোনো কিছু, যা- মনে করুক তাতে আমার মাথাব্যথা নেই এই আকাশের নিচে জীবন যতটুকু পার হয়েছে ততটুকুতে যাদেরকে জীবনের সবকিছু মনে করেছি, যাদের কথার গুরুত্ব দিয়েছি আপ্রাণতারাই তো হৃদয়কে শরবিদ্ধ করেছে, ভালোবাসাকে মনে করেছে অপ্রয়োজনীয় কোনো ভবঘুরে এবং তাকে মাটির ওপর একা রেখে আপন গন্তব্যে হেঁটেছে এই যে আমি আজও সোনালি আলোর নিচে মাছরাঙার মতো বসে আছি, মনে মনে প্রার্থনার আবহে ভাবছি পথে আমার ছেলেটি কি হেঁটে আসবে? সে কি তার বৃদ্ধ পিতাকে দেখতে আসবে? সে কি এটা দেখে অবাক হবে, তার পিতা কতটা নিঃসঙ্গতায় জীবনকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে পার করছে? কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যায় আমি কি বুঝতে পেরেছি, ছেলেটা আর আসবে না, কখনোই না! এভাবেই পথের মানুষ দেখতে দেখতে আমি মৃত্যুকে অতিক্রম করবো
 

দুই.
আমি সাধারণ মানুষ নই কিশোর-যৌবনে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লিখেছি কবি বলে বন্ধুমহলে আমার সম্মান ছিলো গর্ব করার মতো কত মেয়ের ইশারা হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, কত প্রেমের বাঁশি দূর-বহুদূর থেকে বেজে মিলিয়ে গেছে একসময়, আমি সাড়া দিইনি কীভাবে সাড়া দিবো, কাউকেই আমার তেমন ভালো লাগেনি আমার তখন খুব মনে হতো সবাই কবিকে পেতে চায়, এই আমিকে কেউ চায় না কিন্তু একটি মেয়েকে আমার বিশেষ ভালো লেগেছিলো ঠিকই সেই ভালো লাগার ব্যাপারটা এতই কাকতালীয়, রহস্যে ভরা যে এখনও ভাবলে আমি চমকে যাই তার প্রতি ভালোলাগা কেমন যেন ঐশ্বরিক বলে মনে হতো মেয়েটি কোথাও কোনো ভিড়ে, কোনো কোলাহলে, কোনো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়, কোনো বিকেলের পথেযেখানেই থাকুকসেই পথ দিয়ে গেলে আমি ঠিকই টের পেতাম, মেয়েটি এখানে নিশ্চিত আছে এমন ভাবনার পর খুব শীঘ্রই তার দেখা পেতাম, সবসময় হাসিমুখ তার পরে জেনেছি মেয়েটির নাম টাপুর নাম শুনেই হেসে ফেলেছিলাম : টাপুর আবার কারো নাম হয় নাকি! আমার হাসিতে টাপুর সেদিন রাগ করে বলেছিলো, হাসবেন না জানেন, নাম কার ছিলো? আমি তার রাগ দেখে বললাম, আমি কী করে জানবো বলো, টাপুর বলতে আমি এক তোমাকেই চিনি এরপর আরো কয়েকদিন এভাবে দেখা হওয়া, বিবিধ কথা বলার পর কীভাবে কীভাবে যেনো আমার মনে হয়, টাপুরও আমাকে অপছন্দ করে না অতঃপর প্রেমের কথা শরতের এক বিকেলে তাকে বললাম সে হাসতে হাসতে বললো, তুমি না কবি, তুমি প্রেমিকও হবে? আমি বললাম, কবিরা কি প্রেমিক হয়? পারিবারিকভাবে কাজী ডেকে, অনুষ্ঠান করে আমরা বিয়ে করেছিলাম কি চমৎকার সংসার ছিলো আমাদের যেনো ছবির মতো সাজানো গোছানো, জোছনাভরা সংসার কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি, টাপুর বৃষ্টির ফোঁটার মতো ক্ষণিক সেও রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীকে ভালোবাসে এবং একদিন সে আচমকা চলে যাবে টাপুরের প্রস্থান একদমই আচানক, ভাববার অবকাশ পাইনি সে মা হবে, আর আমি বাবাএমন আনন্দ স্পর্শে স্বপ্নমাখা দিন কাটছিলো আমাদের আমি বাবা হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু টাপুর মা হয়েও তার ছেলের মুখ দেখতে পেলো না ছেলের কান্না থামাবো নাকি টাপুরের জন্যে শোক করবোআমার কোনোটাই করা হয়ে উঠেনি আমি বজ্রপাতে বাক্হারা এবং বারবারই মনে করেছিলাম সমুদয় ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি, স্বপ্ন মাত্র, জেগে উঠলে সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে তারপর অসংখ্য শ্রাবণ পার হলো টাপুরকে ছাড়া, তখন আমার পৃথিবী বলতে কেবল মাতৃহীন অরিত্র কবিতা লেখা থেকে বহু আগেই সরে এসেছি, আমার ছেলে অরিত্রই ছিলো আমার সবচেয়ে সফল কবিতা ওকে কী পরিমাণ ভালোবাসি, কী যত্নে বড় করেছি তা একমাত্র ঈশ্বর ভালো বলতে পারবেন অথচ স্রষ্টা কেন যেন বড়ই বিরূপ বারবার, দুঃখই দিয়েছেন প্রতি পদে পদে না হয় কী এমন প্রয়োজন ছিলো অরিত্রের, সে স্ত্রী নিয়ে চলে যাবে শহর থেকে দূরে, ঘরজামাই থাকবে নতুবা অরিত্র কেন ভুলে যাবে তার পিতাকে, যিনি অবর্ণনীয় স্নেহে এবং কষ্টে তাকে যুবক করে তুলেছেন? কেন সে নিরোর মতো নিষ্ঠুর হবে এবং ভুলে যাবে এই ঘাসের ওপরে সে ছাড়া তার বাবার আর কেউ কোথাও নেই আমার অরিত্র এমন ছিলো না ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ হলো, চাকরি নিলো, বিয়েও করালাম তার পছন্দ মতোকিন্তু সবশেষে যে  খা-খা অন্তসার! আমার জীবনের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লাল কালিতে লেখা শূন্য আর অসংখ্য শূন্য যেদিন সে চলে যাবে, সেদিনের দৃশ্যগুলো আজও কষ্ট দেয়, হৃদয়ে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে তীর এসে গেঁথে থাকে সেদিন সকালে নাস্তা করছিলাম অরিত্র বললো,  
একটা কথা ছিলো বাবা
অরিত্র, তুই কী বলবি আমি জানি তোকে তো বলেছিও
বাবা, দেখো, ওখানে না গেলে রূপাকে ডিভোর্স দিতে হবে ওর বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে
তুইও তো আমার একমাত্র ছেলে এখানে আমার কেউ নেই রে
বাবা, প্রতি সপ্তাহে আমি তোমাকে দেখে যাব আর তুমি তো আমাদের ওখানে যাবেই
আমার বয়স হয়েছে শেষ কটা দিন আমার সাথে থাক বেশিদিন তোকে ¦ালাবো বলে মনে হচ্ছে না
তুমি ছেলেমানুষী করছো বাবা রূপাকে আমি ডিভোর্স দিতে পারবো না আমি যাবোই তাছাড়া চাকুরি-বাকরি তো আছেই
আমি কী করবো তাহলে? একা একা এই বয়সে?
সেজন্যেই বলেছিলাম, তোমাকে ওল্ড হোমে থাকতে প্রতি সপ্তাহে একদিন তোমাকে আমরা দেখে আসবো ওখানে থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হবে না আমি সব ব্যবস্থা করবো
আমার বাড়ি, সন্তান থাকতে আমি থাকবো ওল্ড হোমে! তুই কী বলিস্? তোর মায়ের মৃত্যুর পর এই তোকে কত কষ্টে মানুষ করলাম


তারপর কী হলো বলতে আমার ঘৃণা হয় মনের অজান্তেই দেখি শরীর থরথর করে কাঁপছে আমার ছেলে! এই আবদুল আউয়ালের ছেলে এমন নির্মম! নচিকেতার একটা গান ছিলো বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কিত গানটা প্রায় শুনতাম, ঘুণাক্ষরে কখনো ভাবিনি আমার সাথেও এমনটা হবে আমার ছেলে তার স্ত্রী, ক্যারিয়ার আর স্বার্থের জন্যে আমাকে ত্যাগ করবে টাপুর যদি বেঁচে থাকতো তাহলে সে হয়তো তার ছেলের এমন নির্মম কথা শুনে শতবার মারা যেতো অথচ আমি ভাবতাম, অরিত্র ঠিক আমার মতো হয়েছে মানুষকে দুঃখ দেয়া সে শেখেনি, কখনো কবিতা না লিখলেও কবি মন ছিলো তার কিন্তু সবাই কি মানুষ চিনতে পারে? আমি পারিনি অরিত্রের কথায় আমি ওল্ড হোমেও যাইনি অরিত্র রূপা প্রথম প্রথম প্রতি সপ্তাহে আসতো পরে প্রতি মাসে, এরপর বছরে দু তিনবার, এরপর যোগাযোগ, ভালোবাসা এবং দায়িত্ব কর্তব্য মুঠোফোনের কথাবার্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে অরিত্র সর্বশেষ জানিয়েছে, চাকরিতে তার পদোন্নতি হয়েছে সে ভালো আছে এরপর চারবছর পার হয়ে গেছে অরিত্রের ফোনটি বন্ধ বহুদিন ছেলের কণ্ঠটি শোনার জন্যে কতটা আকুল আমিকীভাবে কাউকে বোঝাবো লোকমুখে শুনি, ঘরজামাই থাকলেও ছেলে ভালো আছে কদিন পরেই বাড়িতে আসবে বাবাকে দেখে যাবে পাড়া প্রতিবেশীরা নিয়ে প্রায় কানাঘুষা করে করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়, করুণা করতে চায় আমি হলাম করুণার পাত্র!

সেজন্যেই প্রতিদিন বাড়ির সামনের রাস্তা ছেড়ে শহরের বড় রাস্তার কাছে এসে বসে থাকি এখানে আমাকে কম লোকই চেনে দিন যতই গড়িয়েছে, ততই যেন আমি বদলে যাচ্ছি অরিত্রকে এত ভালোবাসতাম, তার প্রতিই এখন চরম ঘৃণা হচ্ছে ঘৃণার পরিমাণ এতটাই প্রবল যে, আমার মনে হয় আমার হয়তো মস্তিস্ক বিকৃতি হয়েছে আজকাল অরিত্রকে ঘিরে আমি নিজস্ব একটা পরিকল্পনা বানিয়েছি ঘৃণার আগুনে প্রায় রাতে আমি একটি ছুরিতে শান দিই প্রতিরাতেই ছুরিটি চকচক করে আমি ভাবি, অরিত্র যদি একবার আসে, সব ঘৃণা ঢেলে দেব, সব চিহ্ন মুছে দেব ছুরিতে পিতা-পুত্র কোনো বন্ধনের কথা লেখা থাকে না কিন্তু অরিত্র আর আসে না ছুরি প্রায় রাতে চকচক করে


তিন.
আজ বৃষ্টির দিন আমি আগে বৃষ্টি ভালোবাসতাম টাপুরও বৃষ্টি পছন্দ করতো আকাশের মেঘদৈত্যের গর্জন শুনলেই টাপুর আমাকে জড়িয়ে ধরতো আমাদের কাছে বৃষ্টি মানেই ছিলো বিশেষ প্রেমের দিন এখন বয়স হয়েছে চোখেও কম দেখি কিন্তু টাপুরের সাথে কাটানো দিনগুলো আমি এখনো ঝকঝকে দেখতে পাই কতটা রঙিন, ঝলমলে দিনযেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এইমাত্র এঁকে দিয়ে গেছেন শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না, ডাক্তার দেখাতে যাবোকিন্তু মন থেকে কেমন অলসতা ভেসে ভেসে থাকে হয়তো ভাবছি, বেঁচেই আর কী হবে, জীবনেরই মূল্য কী! আর দিনের মতো অরিত্রের অপেক্ষায় বড় রাস্তার দিকে হাঁটছি হালকা বৃষ্টি, তাই মাথার ওপরে ছাতা ডানা মেলে আছে ছাতার ওপর বৃষ্টির শব্দ শুনে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায় মনে হচ্ছে কোনো উন্মাদ চালক স্ট্রীম রোলার চালিয়ে দিচ্ছে আমার বুকের ওপর যেখানে বসি, সেখানে চাররাস্তা এসে মিলিত হয়েছে চৌরাস্তা ছেড়ে আমার গ্রামের দিকে যে রাস্তাটি হনহনিয়ে চলে গেছে, আমি সে রাস্তার মুখে বসে থাকি গত কয়েকদিন ধরে এখানে কে যেন গাছের গুঁড়ি ফেলে রেখেছে একটু দূরে দুটো দোকান জমজ ভাইয়ের মতো বসে আছে আমি মাঝে মাঝে সে দোকানে যাই দোকানদাররা তেমন পাত্তা দেয় না, কথা বললে শুঁয়োরের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠে বৃষ্টি বলেই দোকানগুলোর দিকে এগুই দুটি দোকানেই মানুষ ভরা একটা টিভি চলছে ডানপাশের দোকানে রাজনীতির কথাবার্তা হচ্ছে আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়াই চোখগুলো শহরের রাস্তার দিকে পেতে রাখি


হুঁশহুঁশ করে একটার পর একটা বাস যায় কোনোটা চৌরাস্তায় থামে দু-একজন মানুষ নামে এদের মধ্যে কাউকেই অরিত্রের মতো মনে হয় না অরিত্র হয়তো আর কখনো আসবে না, আমি হয়তো ঘৃণার আগুন নিয়েই মারা যাবো, শোধ নিতে পারবো না এসব যখন ভাবছি, তখনই দেখি দোকানে হাতাহাতি লেগে গেছে হরদমছে চলছে নিলর্জ্জ গালাগালি আজকাল কেন যেন মারামারি দেখতে ভালো লাগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চড়, ঘুষি, লাথি দেখছিহঠাৎই কাঁধে কার যেন হাতের স্পর্শ পেলাম পেছনে ফিরে তাকাতেই মনে হলো স্বপ্ন দেখছি, না হয় মিথ্যা কোনো কিছু অরিত্র হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে অরিত্র গড়গড় করে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে, কেন তার স্ত্রী এলো না, যোগাযোগ করতে পারছে না ইত্যাদি ইত্যাদি আমার কানে কিছু ঢুকছে বলে নিজেরই মনে হচ্ছে না অরিত্রকে নিয়ে যখন হুটতোলা রিক্সায় চড়ে বাড়ি ফিরছি তখন মনে মনে ভাবছি, অরিত্রের কত পরিবর্তন হয়েছে তার মুখভর্তি দাঁড়ি, স্বাস্থ্যও বেড়েছে, স্যুট টাই-পরা যেন অন্য এক অরিত্র ভেতরে ভেতরে অন্যরকম একটা উত্তেজনা বোধ করছি, ঘৃণার রক্ত যেন আবার জেগে উঠেছে অরিত্রকে একবার ঘরে নিতে পারলেই হয় চকচকে ছুরির কথা মনে পড়ে সব ঘৃণা ঢেলে দিবো, সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে হিসাবের খাতা শূন্য করবো

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অরিত্র যেন হতবাক হয়ে গেল বাড়ির কি হাল! মায়ের কবরে এত ঝোঁপঝাড়? ব্যাংকে মাসে মাসে পাঠানো টাকা কি পাননি? আমি দাঁতমুখ খিঁচে থাকি যে ছেলে বাবার খোঁজ নেয় না, তিনমাসে চারমাসে টাকা পাঠায় ব্যাংকেতার টাকা আমি তুলবো? আমি তো ফকির নই, জমানো টাকা বেশি ছিলো না সত্য, কিন্তু এতদিন তো চলেছি, অরিত্রের টাকা নেব কেন কথাগুলো অরিত্রকে বারবার বলতে ইচ্ছে করছিলো, ইচ্ছে করছিলো তাকে গালাগালি করি কিন্তু না, গালাগালি করলে যদি অরিত্র চলে যায়! রাতে খাবার খেতে গিয়ে অরিত্র বারবার আমার চোখের দিকে তাকায় এগুলো কি প্রতিদিন খাও? —হ্যাঁ, খাই আমি আর কথা বাড়াই না দু বাড়ি পার হয়ে এক বিধবা এসে ভাত-তরকারি রেঁধে দেয় হাটবাজার তেমন করা হয় না সবকিছুতেই আমার মধ্যে কেমন যেন একটা নির্লিপ্ত ভাব চলে এসেছিলো অরিত্রকে দেখছি, আর বারবার মনে হচ্ছেএকটা সীমারকে দেখছি আমি, পাপিষ্ঠকে দেখছি রাত বাড়লে অরিত্র বারান্দার খাটটা পরিষ্কার করে শুয়ে থাকে ঘুমানোর আগে বলে যায়, কাল আমাকে সে নিয়ে যাবে শহরে অরিত্রের ঘুমাতে বেশি সময় লাগে না আমি তোষকের নিচ থেকে ছুরিটা বের করে আনি আঙুল দিয়ে ধার পরীক্ষা করি গতকালও ধার দিয়েছি শরীরের ভেতর রক্ত টগবগ করে ফুটছে, ফুটছে আমি একবার বারান্দায় উঁকি দিই অরিত্র এমন নির্মলভাবে ঘুমাচ্ছে যেন ওর কোনো পাপ নেই, পিতার প্রতি অবহেলা নেই অপেক্ষা করি, আরেকটু রাত বাড়ুক বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত বাড়ার অপেক্ষা করি হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছি ছুরি আজ অপেক্ষার অবসান হবে
        

চার.
পরের দিন সকালবেলা আকাশে বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা নেই বাইতুল আমান মসজিদের মাইকে একটি মৃত্যুর খবর প্রচারিত হচ্ছে মোয়াজ্জেম গলায় দরদ ঢেলে বারবার বলছেন, ‘একটি শোক সংবাদ রহিমানগর নিবাসী তালুকদার বাড়ির আবদুল মজিদের পুত্র আবদুল আউয়াল গতকাল রাত আনুমানিক চারটায় হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন ইন্নালইল্লাহে...রাজিউন মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৫৮ বছর তিনি একপুত্র অসংখ্য সুহৃদ রেখে গেছেন

সেদিন থেকে শহরের চৌরাস্তায় সোনালি আলোর নিচে প্রতিদিন মাছরাঙা হয়ে বসে থাকা বৃদ্ধকে আর দেখা যায় না পথিকরা কে কখন গৃহে ফিরছে, কে কথা বলছে কার সাথে কিংবা কার মুখ মন খারাপের বাড়ি হয়ে বসে আছে তার খোঁজও কেউ রাখে না কেবল বৃদ্ধের মৃত্যুর তিনদিন পর অশ্রুসজল চোখে অরিত্রকে একবারের জন্যে চৌরাস্তায় দেখা যায় এবং সে বাসে উঠে সোনালি আলোর মতো দ্রুত শহরের দিকে মিলিয়ে যায়